Boisakh He

Home  »     »   Boisakh He
Sale!

Boisakh He

180.00

10% OFF

  • Publication House
  • Bichitra Publishers

Sample Pages

Description

সংকলন-গ্রন্থ প্রসঙ্গে
সৌ ম্য কা ন্তি দ ত্ত

ঋতুবৈচিত্র্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সখ্য কতখানি— সে তাঁর রচনা পাঠ করলেই বোঝা যায়। এক-একটি ঋতুতে প্রকৃতির এক-এক রকম রূপ, রঙ, বর্ণ, গন্ধের সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানসিক স্থিতি, দর্শন, লেখা-রেখা সবেতেই পরিবর্তিত হয়েছেন এক বিস্তৃত সময় জুড়ে।
এই ধরুন, ‘নটরাজ’ ঋতুরঙ্গশালার প্রসঙ্গই যদি আমরা তুলি। সেখানে ঋতুবৈচিত্র্যের এক আশ্চর্য মায়ার খেলা রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন আমাদের সামনে। সে রচনার গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
“নৃত্য গীত ও আবৃত্তি যোগে “নটরাজ” দোলপূর্ণিমার রাত্রে শান্তিনিকেতনে অভিনীত হইয়াছিল।
নটরাজের ভাণ্ডারে তাঁহার এক পদক্ষেপের আঘাতে বহিরাকাশে রূপলোক আবর্তিত হইয়া প্রকাশ পায়। তাঁহার অন্য পদক্ষেপের আঘাতে অন্তরাকাশে রসলোক উন্মথিত হইতে থাকে। অন্তরে বাহিরে মহাকালের এই বিরাট নৃত্যছন্দে যোগ দিতে পারিলে জগতে ও জীবনে অখণ্ড লীলারস উপলব্ধির আনন্দে মন বন্ধনমুক্ত হয়। “নটরাজ” পালাগানের এই মর্ম্ম।”
এই রচনার প্রসঙ্গ টানলাম এ-কারণেই, ‘নটরাজ’ গীতিনাট্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছ’টি ঋতুর একের-পর-এক আগমন ও প্রস্থানকে আবাহন ও বিদায়ের মধ্যে দিয়ে বর্ণনা করেছেন। যদিও আমাদের এই সংকলন-গ্রন্থের বিষয় তাঁর বৈশাখী-সৃষ্টি। অর্থাৎ, বৈশাখ-এর তপ্ত বাতাস, দারুণ অগ্নিবাণের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতির আদি-অকৃত্রিম বর্ণনা, পুরানো যা-কিছু আবর্জনা— তার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে নববর্ষকে বারবার আহ্বান জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
এই সংকলন-গ্রন্থে কবিতা ও গান মিলয়ে রবীন্দ্র-রচিত মোট তেষট্টি খানি রচনা সংকলিত হয়েছে। এই লেখাগুলির অধিকাংশই বৈশাখ মাসে রচনা। তাহলে কি বৈশাখে রচিত সব গান ও কবিতাই এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে? পাঠক-পাঠিকার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে। সেই কৌতূহল মেটাতে বলতে পারি, না— বৈশাখে রচনা অথচ সে গান বা কবিতায় কবি বৈশাখ-এর কোনও বর্ণনা দেননি, কিন্তু কবিমানসে তখন অন্য ভাবধারা বহমান, কোনও অনুষঙ্গই নেই— এমন রচনা এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আবার অন্য ক্ষেত্রে বৈশাখের প্রকৃতি বর্ণনার পাশাপাশি কবি নববর্ষ এবং তাঁর জন্মদিনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন বেশ কিছু কবিতায়, গানে। এ বিষয়ে দু’টি ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়।
প্রথমত, বারো মাসে তেরো পার্বণের জাতি বাঙালির নববর্ষ এক অন্যতম পার্বণ। এই নববর্ষকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন বেশ কিছু কবিতা ও গান। সে সমস্ত রচনায় কবি পুরনোকে আমল দিয়েই নতুনকে সাগ্রহে কাছে টেনে নিয়েছেন। নতুনের মধ্যে দিয়ে আনন্দের বাতাবরণে সাজিয়ে তুলেছেন তাঁর রচনাকে। এই বইয়ের একটি [১৫নং] কবিতায় কবির লেখা থেকে আমরা পাচ্ছি—
“নববর্ষ এল আজি
দুর্যোগের ঘন অন্ধকারে;
আনে নি আশার বাণী,
দেবে না সে করুণ প্রশ্রয়।”
এখন, নতুনের আনন্দ-ঘেরা মুহূর্তকে উপলব্ধি করা ছাড়াও, কবি জানিয়েছিলেন নববর্ষ সমস্ত সময়, সব ক্ষেত্রে আশার বাণী বয়ে আনবে— তা নয়। দুঃখের মধ্যে দিয়ে সুখকে খুঁজে নেওয়া, দুঃখের মধ্যেই নিজেকে সচল রাখা, সুখী রাখার দারুণ প্রচেষ্টা ও কঠিন তপস্বায় ব্রতী ছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ। অজস্র ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে তাঁর জীবন কেটেছে, অথচ কোনওরূপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সে-সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাত বাঁধা তৈরি করতে পারেনি। স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টিতে মজে থেকেছেন আমৃত্যু। পাশাপাশি জীবনের মূল্যকে আত্মউপলব্ধির দ্বারা তিনি বিচার করেছেন, কোনওপ্রকারের দেনার ভার বজায় রাখতে চাননি তিনি। কবি লিখেছিলেন—
“যে জীবন বহিয়াছি
পূর্ণ মূল্যে আজ হোক কেনা;
দুর্দিনে নির্ভীক বীর্যে
শোধ করি তার শেষ দেনা।”

মানসিক স্থিতি, দর্শন যেমন তাঁর বৈশাখের রচনায় ফুটে উঠেছে বারংবার, ঠিক তেমনই প্রকৃতির বৈশাখী-বর্ণনাও ঘুরে-ফিরে এসেছে কবির রচনায়। সে বৈশাখের তীব্র দাবদাহ হোক, কি কালবৈশাখীর বর্ণনাই হোক। প্রকৃতির এই ঋতুবৈচিত্র্যপ্রেমে কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর সোনার কলমে সৃষ্টি করেছেন একের-পর-এক গান, কবিতা। এই সংকলন-গ্রন্থের একটি [১৪নং] কবিতা থেকে আমরা পাচ্ছি বৈশাখের এক অসাধারণ বর্ণনা, যার শুরুতেই রয়েছে—
“হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!
ধূলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,
তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল
কারে দাও ডাক,
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!”
আমরা জানি, ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ দিনটিতে তাঁর জন্ম। কাজেই বৈশাখ মাসটি আমাদের কাছে কবির জন্মমাস হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একটি ব্যাপার বলে রাখা প্রয়োজন, তীব্র দাবদাহ এবং জল কষ্টের কারণে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতে গ্রীষ্মাবকাশ শুরু হত পয়লা মে থেকে। কিন্তু, কবির জন্মদিন ২৫শে বৈশাখ, ইংরিজি তারিখ অনুযায়ী ৮ অথবা ৯ মে নাগাদ হওয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথ স্বদিচ্ছায় তাঁর জন্মদিনটি ২৫শে বৈশাখের বদলে ১লা বৈশাখ, নববর্ষের সঙ্গেই পালন করা শুরু করলেন ১৯৩৬ বঙ্গাব্দ থেকে।
এই জন্মদিনকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু কবিতা রচনা করেছেন। যদিও সে সব কবিতার সবই যে বৈশাখ মাসেই রচিত—তা কখনোই নয়। এ গ্রন্থের একটি [২৭নং] কবিতাটি লেখা হয়েছে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ৩০ আশ্বিন।
আবার, অন্য একটি [৩৮নং] কবিতা, যেটি রচিত হয়েছিল ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখের দিনটিতেই। কবি তখন কালিম্পং-এ। বলা বাহুল্য, এই কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর অতি প্রিয় ‘গৌরীপুর ভবন’-এ থাকাকালীন রচনা করেন। এই জন্মদিনের প্রসঙ্গ উঠতেই এই গ্রন্থে সংকলিত আরও চারটি কবিতার [৩৩নং, ৩৪নং, ৩৫নং, ৩৬নং] কথা মনে পড়ল, যেগুলো উল্লেখ করার যথেষ্ট প্রয়োজন আছে বলে আমাদের বিশ্বাস। উল্লেখিত চারটি কবিতাই কবি মংপু-তে বসে রচনা করেন। এবং এই চারটি কবিতারই রচনাকাল ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস। অর্থাৎ কবি-প্রয়াণের ঠিক এক বছর তিন মাস কি চার মাস আগে। রবীন্দ্রভবন অভিলেখাগারে সংরক্ষিত কবির এই চারখানি কবিতার পাণ্ডুলিপিতে সনের উল্লেখ পাওয়া গেলেও রচনার নির্দিষ্ট তারিখের কোনও উল্লেখ নেই। যাই হোক, এই মংপুর প্রসঙ্গ উঠতেই যে-কোনোও রবীন্দ্রচর্চার মানুষের মনে পড়ে যাবে মৈত্রেয়ী দেবীর কথা ও তাঁর লেখা ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ নামক অসাধারণ বইটির কথা। সে বইয়ের একেবারে শেষের দিকে (পৃষ্ঠা নং ১৭৬) মৈত্রেয়ী দেবী জানিয়েছিলেন, সে বছর পঁচিশে বৈশাখের দু’-তিনদিন আগে এক রবিবারের সকালবেলা কবির জন্মদিন উপলক্ষে মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবীদের বাড়িতেই একটি ঘরোয়া উৎসবের আয়োজন করা হয়। কবির জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথের সপরিবার আসার কথা। সেই রবিবার সকাল দশটা নাগাদ রবীন্দ্রনাথ স্নান সেরে কালো রঙের জামা আর কালো রঙেরই জুতো পরে বাইরে এসে বসেছিলেন এবং তারপর তিনি ঈশোপনিষদ থেকে বেশ খানিকটা অংশ পাঠ করেছিলেন। কাঠের একটি বুদ্ধমূর্তির সামনে একজন বৃদ্ধ বৌদ্ধ স্তোত্র পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। সেদিনই দুপুরবেলা ‘জন্মদিন’ নামে তিনটি কবিতা রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে এই লেখায় কিছু আগেই উল্লেখিত সেই চারটি কবিতার প্রথম তিনটি কবিতাই ওইদিন রচিত হয়েছিল। এবং চতুর্থ কবিতাটি রচিত হয় তার পরেরদিন, সকালবেলায়। এই চারটি কবিতাই প্রকাশিত হয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। প্রথম তিনটি ছাপা হয় যথাক্রমে ‘জন্মদিন ১’, ‘জন্মদিন ২’, ‘জন্মদিন ৩’ নামে এবং চতুর্থ কবিতাটি ছাপা হয় ‘জন্ম-মৃত্যু’ শিরোনামে।
এই সংকলন-গ্রন্থের পাঠক-পাঠিকা ভাবতেই পারেন, এই লেখায় ‘জন্মদিন’ প্রসঙ্গ টানলাম কেন! এক্ষেত্রে বলি, পূর্বে উল্লেখিত, কবির জন্মমাস বৈশাখ আর আমাদের এই গ্রন্থের মূল ভিত্তি তাঁর বৈশাখী-সৃষ্টি— কাজেই, জন্মদিন প্রসঙ্গকে দূরে সরিয়ে দিই কেমন করে?

এই গ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা ও গানই ‘গীতবিতান’-এর ‘পূজা’ পর্যায়, ‘প্রকৃতি’ পর্যায়, ‘প্রেম’ পর্যায় থেকে সংগৃহীত হয়েছে। এছাড়া, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ, যেমন— ‘শেষ সপ্তক’, ‘স্ফুলিঙ্গ’, ‘উৎসর্গ’, ‘গীতিমাল্য’, ‘বলাকা’, ‘পরিশেষ’, ‘শেষ লেখা’, ‘জন্মদিন’, ‘সেঁজুতি’, ‘নবজাতক’, ‘খেয়া’, ‘চৈতালী’, ‘প্রান্তিক’, ‘পূরবী’, ‘মানসী’ থেকে বিভিন্ন কবিতা ও গান সংগৃহীত হয়েছে। দু’-একটি কবিতার সঙ্গে বৈশাখের প্রত্যক্ষ যোগ না-থাকলেও পরোক্ষ যোগ আছে বৈকি! যেমন এই গ্রন্থের একটি [৪৭নং] কবিতার (“মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ…”) সঙ্গে বৈশাখের সরাসরি কোনও সংযোগ হয়তো নেই। সাদা চোখে এমনটা মনে হওয়াও কোনও অপরাধ নয়। কিন্তু, আমরা যদি এর পেছনের ইতিহাসটা একটু তলিয়ে দেখি তাহলে জানতে পারছি, ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ কবির ৬৪তম জন্মদিন উপলক্ষে শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে সকাল ৬টায় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, দিলীপকুমার রায়, অশ্বিনীকুমার ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র-এর মতো ব্যক্তিরা। রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে গানের দল দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে বেদ্‌গান গেয়েছিলেন, তারপর পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী স্বস্তিবচন পাঠ করেছিলেন। এরপর সকাল ৭:৩০ নাগাদ উত্তরায়ণের উত্তর সীমানায় পঞ্চবটী (পাঁচটি বৃক্ষ, যথাক্রমে— অশ্বাত্থ, বট, বেল, অশোক ও আমলকী) রোপিত হল, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বীরভূমের প্রবল গ্রীষ্মে যে কোনও পথ-ক্লান্ত পথিককে, পশু-পাখিকে এই বৃক্ষগুলি শীতল ছায়া প্রদান করে। এবং এই উপলক্ষে গীতি-পত্রীতে যে পাঁচটি গান ছিল, সেগুলো গাওয়া হলে পর “মরু বিজয়ের কেতন উড়ায় শূন্যে” গানটিই গাওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ এই অনুষ্ঠান উপলক্ষেই এই গানটি রচনা করেন। কাজেই বৈশাখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগের ব্যাপারটা যদি এড়িয়ে যাই, সেক্ষেত্রে এই সংকলন-গ্রন্থটি কতখানি স্বয়ং সম্পূর্ণ হ’ত সে বিষয়ে আমাদের সন্দেহ আছে।

Reviews

There are no reviews yet.

Be the first to review “Boisakh He”

Your email address will not be published. Required fields are marked *